আমাদের রংপুর সবদিক থেকে পিছিয়ে থাকলেও কবিরাজ মার্কা সাংবাদিক তৈরিতে পিছিয়ে নেই। যার উদাহরণ নির্বাচনের সময় সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে। ভোট কেন্দ্রগুলোতে গলায় ফিতা ঝুলানো নতুন নতুন অসংখ্য সাংবাদিক দেখা যায়। যাদের বেশির ভাগই শুধু একদিনের জন্য পাঁচ বছর পর পর সাংবাদিক হয়ে ভোট কেন্দ্রে আসেন খবর সংগ্রহে। এটা হয়তো সারা দেশের চিত্র হতে পারে, তবে আমার দৃষ্টিতে রংপুরে এমন সাংবাদিকের সংখ্যা তুলনামূলক বেশি।
আবার কিছু কিছু সাংবাদিককে দেখা যাবে শুধুমাত্র মানববন্ধনে, সভা-সেমিনারে, ফটোসেশন আর স্টিকারধারী বাহনে। এদের দেখলে মনে হবে অনেক লম্বা মাপের সাংবাদিক এরা। কিন্তু যখন খাতা-কলম কিংবা কম্পিউটার-ল্যাপটপ নিয়ে নিউজ লেখার জন্য বলবেন, তখন তাদের বেশির ভাগকেই আর খুঁজে পাবেন না। এদের মধ্যে অনেকের সাথে সরকারি অফিস-আদালতের বড় বড় কর্তাবাবুদের সেইরকম সম্পর্ক।
সাংবাদিকতায় শিক্ষাগত যোগ্যতার কথা নাই বললাম। কারণ অনেকের কাছে এখনকার যুগে শিক্ষাগত যোগ্যতা তেমন কোনো ব্যাপার না। তারা তো অনেক বড় সাইজের সাংবাদিক। তাই কথায় কথায় তারা কাজী নজরুল ইসলামকে টেনে আনেন। বলেন_নজরুল কী পাস…? ওমুক সাংবাদিক কী পাস, তমুক হাম্বাদিক কী পাস? আগে পড়াশোনা না করে এইট-নাইন-টেন টেনে টুনে কতজনেই সাংবাদিক হয়েছে। তাহলে এখন কেন সাংবাদিকতা করতে গেলে শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রশ্ন উঠে .. ?
আমি তাদের প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে চিন্তা করি, আগে তো শিক্ষকতা করতে এসএসসি বা এইচএসসি পাস হলেই চলতো। পুলিশে নাকি এইট পাসেও চাকরি মিলতো। এখন তাহলে চাকরি হয় না কেন? আগে তো সাংবাদিকতা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এত পড়াশোনা ছিল না, এখন হচ্ছে কেন? আগে তো কখনো সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে স্বীকৃতির দাবি তোলা হয়নি, এখন কেন পেশার দাবি, গণমাধ্যমকে শিল্প হিসেবে দাবি করা হচ্ছে?
নিশ্চয়ই কোথাও ভুল হচ্ছে। তা নাহলে চব্বিশের জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর কেন গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন গঠন হলো? কেন এত এত প্রস্তাবনা কমিশন তুলে ধরলো? যদি ইচ্ছে হলেই সাংবাদিকতায় নাম লেখা যায়। যদি কোনো নিয়ম নীতির বালাই না থাকে, তাহলে তো গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবনা জুলাই চেতনার স্প্রিটের সাথে সাংঘর্ষিক।
এটা লিখতে লিখতে একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল। কিছু দিন আগে প্রেসক্লাবের বারান্দায় দাঁড়িয়ে মোবাইলে একটা নিউজ লিখছিলাম। হঠাৎ মনি লাইব্রেরির পাশের দোকানে একজনকে চোখে পড়লো। লোকটা বেশ কিছু পত্রিকা বারবার উল্টাপাল্টা করে কিছু একটা খুঁজতে চেষ্টা করছিল। আমি কাছে যেতেই হাত বাড়িয়ে দিয়ে কুশল বিনিময় করলো। যদিও আমার কাছে তাকে পরিচিত মুখ মনে হয়নি।
তার জানতে চাইলাম, পত্রিকায় কিছু আছে নাকি ভাই? সে বললো- ভাই গতকাল একটা নিউজ পাঠিয়েছি, কিন্তু খুঁজে পাচ্ছি না। আমি বললাম কিসের নিউজ? সে বললো, ছবিটা ছাপায় নিতো এ জন্য নিউজটা খুঁজতে পাচ্ছি না। আমি তার কাছ থেকে নিউজের বিষয়বস্তু জানার পর বললাম- দিবসের নিউজগুলো অনেক সময় সারাদেশ মিলে “কম্বাইন” করা হয়। একারণে কখনো কখনো সোর্স লাইনে ডেস্ক লেখা থাকে।
আমি তাকে নিউজটা খুঁজে বের করে দেখিয়ে দিয়ে বললাম, এইটা আপনার নিউজ তো? সে কিছু না বলে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, ভাই ইংরেজি পত্রিকায় ছবি ছাড়া নিউজ ছাপালে খুঁজে বের করতে কষ্ট হয়। তারপর সে আমাকে চা খাওয়ানোর জন্য অনেক চেষ্টা করলো কিন্তু আমি তাতে সাড়া দেইনি। ততোক্ষণে ভাবলাম নিজের নিউজ যেই ভাই ছবি ছাড়া ফাইন্ড আউট করতে পারে না, সে কিভাবে সাংবাদিক..!?!
যাইহোক, ওই ব্যক্তি সম্পর্কে পরে এক বড় ভাইয়ের কাছে জানলাম, সে রিপোর্টার নয় সাংবাদিক। নিউজ লিখতে পারে না কিন্তু তথ্য সংগ্রহ করে। অফিস আদালত থেকে ভালো বিজ্ঞাপনও পায়। একটা ইংরেজি আর দুইটা বাংলা পত্রিকায় কাজ করে। এই ভাইও এবার রংপুর প্রেসক্লাবের সদস্য হতে আবেদন করেছেন।
ঐতিহ্যবাহী রংপুর প্রেসক্লাবে এবার সদস্য হিসেবে অর্ন্তভুক্ত হতে ২০০ জনের বেশি আবেদন করেছে। যাদের বেশিরভাগই কবিরাজের পানি পান করা, গলায় তাবিজ ঝুলানো, দলকানা, খোরা-ন্যাংড়া, আন্ডার মেট্রিক, সিসিপি (কপি+কাট+পেস্ট) অনুসারী, নামধারী ও সিন্ডিকেটের আওতাভুক্ত খ্যাতি সম্পন্ন সাংবাদিক। তাদের কাউকে নিয়ে আমার কোনো অভিযোগ নেই। কারণ গণমাধ্যম যাদের হাতে তারাই তো এমন কবিরাজদের নাটেরগুরু। কর্তৃপক্ষ বলে একটি কথা আছে, এই কর্তৃপক্ষের মারপ্যাচে আমাদের এই পেশার মান এখন তলানিতে, মর্যাদাও হাবুডুবু খাচ্ছে। গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ, বিতর্ক তো পিছুই ছাড়ছে না।
এত কিছুর পরও রংপুরের সাংবাদিক সমাজ এবং প্রেসক্লাবের জন্য ভালো খবর হচ্ছে, পিছনের দরজা দিয়ে হলেও দেশের বেশকিছু ভালো গণমাধ্যমের নামকরা পেশাদার এবং দায়িত্বশীল সাংবাদিকরা এবার এই সংগঠনের সদস্য হতে যাচ্ছেন। যারা সত্যিকার অর্থে এটার দাবিদার। কিন্তু আমার ভাবনা সেখানেই- মনের মধ্যে শান্তি খুঁজে মিলবে তো?
যারা সদস্য হতে যাচ্ছেন, তারা কোনো দিনও নিজেদের বিবেকের কাছে প্রশান্তি খুঁজে পাবেন না। কারণ পুরো প্রক্রিয়া অবৈধ, বিতর্কিত, পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে সাজানো। তারপরও আপনাদের জন্য শুভকামনা। স্বাগত জানাই সমাজসেবার ঘাড়ে ভর করে বহুদিনের অপচেষ্টায় যারা আপতত নিজেদের বিজয়ী ভাবছেন।