সেভেন সিস্টার্স কি?

সেভেন সিস্টার্স কি?

সেভেন সিস্টার্সে অরুণাচল, আসাম, মণিপুর, মেঘালয়, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড এবং ত্রিপুরা রয়েছে
ত্রিপুরার সাংবাদিক জ্যোতি প্রসাদ সাইকিয়া সর্বপ্রথম রাজ্যগুলোকে ‘সেভেন সিস্টার্স’ নাম দেন

ভারতে উত্তর-পূর্ব দিকে, চিন, বাংলাদেশ এবং মায়ানমার দেশের সীমান্তে অবস্থিত সাতটি রাজ্যকে একসঙ্গে বলা হয় ‘সেভেন সিস্টার’ বা সাত বোন।

এসব রাজ্যগুলো একে অপরের ওপর নির্ভরশীল হলেও সংস্কৃতি, পরিবেশের দিক থেকে তাঁরা স্বতন্ত্র। এসব রাজ্যের বেশিরভাগ মানুষই নানা আদিবাসী জাতি এবং উপজাতি সম্প্রদায়ের।

এই সাতটি রাজ্য বা সেভেন সিস্টার্সের মধ্যে রয়েছে অরুণাচল প্রদেশ, আসাম, মণিপুর, মেঘালয়, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড এবং ত্রিপুরা। এখন প্রশ্ন আসে যে এই সাতটি রাজ্যকে কেন সেভেন সিস্টার বা সাত বোনের রাজ্য বলা হয়? চলুন জেনে নেওয়া যাক।
সেভেন সিস্টার্স

এই সাত রাজ্যের মোট আয়তন ২,৬২,১৮৪ বর্গকিলোমিটার, ভারতের প্রায় ৪ শতাংশ এলাকা নিয়ে গঠিত। দক্ষিণ-পশ্চিমে বাংলাদেশের সাথে ১,৫৯৬ কিলোমিটার (৯৯২ মাইল) আন্তর্জাতিক সীমানা রয়েছে।

এই সাতটি রাজ্যে জাতিগত এবং ধর্মীয় বৈচিত্র্য বিদ্যমান থাকলেও রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তাদের মিল রয়েছে। ভূরাজনৈতিকভাবে এদের অবস্থান, প্রাকৃতিক সম্পদ এবং বৈচিত্র্যময় সামাজিক কাঠামোর কারণে সারা বিশ্বে অতুলনীয়।

আসলে এই সাতটি রাজ্য একে অপরের উপর নির্ভরশীল এবং একই সময়ে এই রাজ্যগুলি সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক অবস্থাও একই বলে মনে করা হয়, তাই এই সমস্ত রাজ্যগুলিকে একত্রে সেভেন সিস্টার বলা হয়েছে।

ত্রিপুরার সাংবাদিক জ্যোতি প্রসাদ সাইকিয়া সর্বপ্রথম রাজ্যগুলোকে একত্রে ‘সেভেন সিস্টার্স’ নামে উল্লেখ করেন।

১৯৭২ সালে এই সাত রাজ্যকে সেভেন সিস্টার্সের মর্যাদা দেওয়া হয়। আসামের মাধ্যমে রাজ্যগুলো ভারতের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। আগে এসব রাজ্য ভারতের অন্তর্ভুক্ত ছিল না।

স্থানীয় আদিবাসী রাজারা দীর্ঘদিন এসব অঞ্চল শাসন করেন। গারো, খাসিয়া, ত্রিপুরা, বোরো, মিজো আদিবাসী অধ্যুষিত রাজ্যগুলোর অধিবাসীরা দীর্ঘদিন ধরে নাগাল্যান্ড, মণিপুর, অরুণাচল, মিজোরাম, আসাম রাজ্য নিয়ে নাগা স্বাধীন ভূমি গড়ার দাবি তুলছে। সম্প্রতি ভারতের স্বাধীনতা দিবসে মণিপুর রাজ্যে কয়েক হাজার লোক নাগা পতাকা উড়িয়ে স্বাধীন ভূমির পক্ষে সমর্থন দেয়।

একনজরে সেভেন সিস্টার্সের বর্ণনা

অরুণাচল প্রদেশ

উত্তর-পূর্ব ভারতের একটি স্থলবেষ্টিত রাজ্য অরুণাচল রাজ্য। এর দক্ষিণে ভারতের অঙ্গরাজ্য আসাম, , পশ্চিমে ভুটান, উত্তর ও উত্তর-পূর্বে চীন, এবং পূর্বে মিয়ানমার। অরুণাচল প্রদেশের আয়তন ৮৩,৭৪৩ বর্গকিলোমিটার এবং এর রাজধানী ইটানগর। চীনের তিব্বতের সাথে অরুণাচল প্রদেশের ১১২৯ কিলোমিটার দীর্ঘ আন্তর্জাতিক সীমানা রয়েছে।

অঙ্গরাজ্যটির উদ্ভিজ্জ ও প্রাণীজীবনে এর বিচিত্র ভূপ্রকৃতি ও জলবায়ুর প্রভাব দেখতে পাওয়া যায়। প্রাণীর মধ্যে বাঘ, চিতা বাঘ, তুষার চিতা, হাতি, লাল পান্ডা এবং হরিণ উল্লেখযোগ্য।

এ প্রদেশের উঁচুনিচু, এলোমেলোভাবে বিস্তৃত ঢালযুক্ত ভূখণ্ড প্রদেশটিকে দিয়েছে আলাদা মাত্রা। তাছাড়াও এর রয়েছে বিশাল হিমালয়ের উচ্চশৃঙ্গ।
আসাম

১৮২৬ সালে ইয়াণ্ডাবু চুক্তির মাধ্যমে আসাম প্রথম ব্রিটিশ ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়। তবে স্বাধীনতার পর আসাম রাজ্যের পুনর্গঠন হয়। ভূমি অসমতল (অসমভুমি) হওয়ায় রাজ্যটি অসম, পরবর্তীতে আসাম নামে অভিহিত করা হয়। একে ঘিরে রয়েছে ত্রিপুরা, নাগাল্যান্ড, মেঘালয়, মিজোরাম, মণিপুর ও অরুণাচল প্রদেশ। এর আয়তন ৭৮,৪৩৮ বর্গকিলোমিটার।

আসামের আন্তর্জাতিক সীমানা রয়েছে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভুটান এবং বাংলাদেশের সঙ্গে।

দেশের উত্তর-পূর্ব দিকের প্রবেশদ্বার আসাম ঘন সবুজ বন, উর্বর সমভূমি, বিশালাকায় ব্রহ্মপুত্র নদ, সুন্দর পাহাড়, নীলাভ পর্বত, বিস্ময়কর চা চাষের উপত্যকা এবং প্রসিদ্ধ উদ্ভিদ ও প্রাণীকূল দ্বারা সমৃদ্ধ।
মেঘালয়

মেঘালয়ের রাজধানী শিলং। এটি ভারতের ২১তম রাজ্য। এর আয়তন ২২,৪২৯ বর্গকিলোমিটার। গারো পাহাড়, খাসি পাহাড়, জয়ন্তিয়া পাহাড়ের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে এই রাজ্যটি। ১৯৭০ সালে আসামের দুটি জেলা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মেঘালয়ের জন্ম হয়েছিল। ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর বাংলা ভাগ হওয়াকালীন মেঘালয় পূর্ব বাংলা ও আসামের এক নতুন প্রাদেশিক অংশ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।

ছবির মতো সুন্দর একটি রাজ্য মেঘালয়। সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণে এই মেঘালয়কে বলা হয় ‘প্রাচ্যের স্কটল্যান্ড’।
মিজোরাম

মিজোরামের রাজধানী আইজল। এটি উত্তর ও দক্ষিণ লুসাই পার্বত্য জেলাগুলোর সমন্বয়ে গঠিত। এর আয়তন ২১,০৮৭ বর্গকিলোমিটার। এটি দেশের ২৩তম রাজ্য।প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশ এবং মিয়ানমারের প্রায় ৭২২ কিলোমিটার এলাকা নিয়ে মিজোরামের সীমানা অবস্থিত।

এই রাজ্যের বিশাল পাইনের গুচ্ছ, নান্দনিক প্রাকৃতিক দৃশ্য, বাঁশের ওপর নির্মিত ঘরের গ্রাম দেয় অপূর্ব সৌন্দর্য। খ্রিস্টীয় ১৭৫০ থেকে ১৮৫০ সালের মধ্যে মিজো উপজাতিরা নিকটস্থ চীন পর্বত থেকে এসে এখানকার স্থানীয় আদিবাসীদের পরাজিত করে বসতি স্থাপন শুরু করে এবং নিজস্ব একটি সমাজব্যবস্থার সূচনা করে।
নাগাল্যান্ড

রাজ্যের রাজধানী কোহিমা, এবং বৃহত্তম শহর ডিমাপুর। এই রাজ্যের আয়তন ১৬,৫৭৯ বর্গকিলোমিটার। এটি ভারতের ক্ষুদ্রতম রাজ্যগুলির মধ্যে একটি।

ভারতের স্বাধীনতার ঠিক আগের দিন ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট নাগারা নিজেদের স্বাধীনতা ঘোষণা করেও সুফল পায়নি। ১৯৫১ সালের মে মাসে নাগাল্যান্ডে একটি স্বতঃস্ফূর্ত গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। এতে নাগাদের স্বাধীনতার পক্ষে পূর্ণ সমর্থন প্রকাশ পায়। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার তাদের পক্ষ সমর্থন করেনি। অবশ্য ১৯৬৩ সালে আসাম থেকে আলাদা করে ভারতের ১৬তম রাজ্য হিসেবে গঠন করা হয় নাগাল্যান্ড।
ত্রিপুরা

ভারতের তৃতীয় ক্ষুদ্রতম রাজ্য হল ত্রিপুরা, যার আয়তন ১০,৪৯১ কিমি। এই রাজ্যের রাজধানী হল আগরতলা। রাজ্যটি প্রায় ৩৬ লাখ জনসংখ্যাসহ সপ্তম সর্বনিম্ন জনবহুল রাজ্যের অবস্থানে রয়েছে। এটি পূর্বে আসাম এবং মিজোরাম রাজ্য এবং উত্তর, দক্ষিণ ও পশ্চিমে বাংলাদেশ দ্বারা বেষ্টিত।

ত্রিপুরায় সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির সাথে ১৯টি ভিন্ন উপজাতি সম্প্রদায় রয়েছে। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, ত্রিপুরা হল ভারতের অন্যতম শিক্ষিত রাজ্য, যেখানে সাক্ষরতার হার প্রায় ৮৭.৭৫%।

ত্রিপুরা ১৯৪৯ সাল থেকে স্বাধীন ভারতের একটি অংশ হয়। ১৯৫৬ সালে রাজ্যটি কেন্দ্রশাসিত একটি অঞ্চলে রূপ নেয়।
মণিপুর

মণিপুরের রাজধানী হলো ইম্ফল। এর আয়তন প্রায় ২২,৩২৭ বর্গকিলোমিটার। ১৯৯৭ সালে রাজধানীটি পূর্ব ইম্ফল ও পশ্চিম ইম্ফল নামে দুই ভাগে বিভক্ত হয়। ভারতের স্বাধীনতার পর মণিপুর সংবিধান আইন প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর ১৯৭২ সালের ২১ জানুয়ারি মণিপুর পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা অর্জন করে।

১৯৪৭ সালে মনিপুর স্বাধীন রাজ্য হিসেবে আত্মপ্রকাশের ইচ্ছা প্রকাশ করে। পার্শবর্তী বার্মার আগ্রাসী মনোভাবে ১৯৪৯ সালে রাজা বোধচন্দ্র সিং ভারত অন্তর্ভুক্তির সম্মতিপত্রে সই করেন। ১৯৫৬ সালে এটি কেন্দ্র শাসিত রাজ্য হয়। ১৯৭২ সালে তা পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা পায়।

মণিপুরে তিন গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের বাস: বিষ্ণুপ্রিয়া, মৈতৈ ও পাঙান। বিরল প্রজাতির হরিণ ‘সাংগাই’-এর বসবাসস্থলও এখানে। জওহরলাল নেহেরু মণিপুরকে ‘ভারতের রত্ন’ হিসেবে বর্ণনা করেন।

Please Share This Post in Your Social Media

Comments are closed.

© All rights reserved © Rangpur24.com
Desing & Developed BY NewsSKy